আইনের দৃষ্টিতে যেকোনো হত্যাই চরম অপরাধ কিন্তু যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য থাকে না সে ক্ষেত্রে কখনো কখনো তা আইনের চোখে মার্জনীয় হতে পারে এবং এর শাস্তি কিছুটা লঘু হতে পারে। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। চালকরা এতটাই বেপরোয়া যে, তা দেখে মনে হয় প্রতিটি মৃত্যুই যেন ইচ্ছাকৃত হত্যার শামিল। ফলে দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের দাবি অনেকদিনের।
দুজন কোমলমতি শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর খসড়া। নতুন আইন অনুযায়ী বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর দায়ে কেউ আহত বা নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারা অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির বিচার হবে। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। বর্তমান এই আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে এবং নতুন আইনে তা পাঁচ বছর পর্যন্ত রাখা হয়েছে। নতুন আইনটিতে আরও বলা হয়েছে গাড়ি চালানোর কারণে কারো নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে হত্যা বলে প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রয়োগ হতে পারে।
সড়কের ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো ধরনের মোটরযান চলাচল করলে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। যদি কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালায় তবে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কেউ এই অপরাধ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। চালকের সহকারীর লাইসেন্স লাগবে। কন্ডাক্টরের লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে।
নতুন আইন অনুযায়ী পেশাদার চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ন্যূনতম বয়স ২১ বছর হতে হবে এবং অপেশাদার চালকদের ক্ষেত্রে লাইসেন্স পেতে হলে অষ্টম শ্রেণি পাস ও ১৮ বছর হতে হবে। এছাড়া প্রতিটি লাইসেন্সেপ্রাপ্ত চালকের জন্য থাকবে ১২ পয়েন্ট। অপরাধ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে। নির্ধারিত ১২ পয়েন্ট শেষ হয়ে গেলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
চলন্ত গাড়িতে ফোনে কথা বলার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। খসড়া আইনানুযায়ী গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। চলন্ত গাড়িতে কেউ মোবাইল ফোনে কথা বললে সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স করলে বর্তমান আইনে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে জরিমানা বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে।
ফিটনেস না থাকা মোটরযান চালালে বর্তমানে শাস্তি রয়েছে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা। সেখানে এখন শাস্তি সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গাড়ির মালিকের জন্য এ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
বিআরটিএ এর হেল্পডেস্ক রয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। একজন সেবাপ্রার্থী কী করে কোনো অনিয়ম ছাড়া সর্বোচ্চ সেবা পেতে পারেন সে বিষয়ে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। হেল্পডেস্কে সেবাদানকারীদের আরও সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কোনো অনিয়ম হলে একজন ব্যক্তি কার কাছে অভিযোগ করবেন এবং প্রতিকার পাবেন সে ব্যাপারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। একজন চালকের লাইসেন্স আছে কিন্তু তিনি তা পেয়েছেন অবৈধ উপায়ে, কাজেই সে ক্ষেত্রে সেই লাইসেন্স থাকা না থাকা সমান ব্যাপার।
শুধু চালকের ব্যাপারে কঠোর হলেই হবে না। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষেরও অনেক অনিয়ম রয়েছে যার কারণে প্রতিনিয়ত এই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। শুধু আইন থাকলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। একজন চালকের লাইসেন্স পাবার প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণভাবে স্বচ্ছ করতে হবে। টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সর্বসাধারণকে সড়ক আইন সম্পর্কে আরও শিক্ষিত করতে হবে। রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে ট্রাফিক সপ্তাহ। কিন্তু এই ট্রাফিক সপ্তাহে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়কের যত্রতত্র অবৈধভাবে যানবাহন পার্ক করা। সংশ্লিষ্টরা দেখেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সব ধরনের অনিয়ম বন্ধ না করলে সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল থামবে বলে মনে হয় না।
লেখক: ব্যারিস্টার এট ল’, লিংকন্সইন, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট এবং একজন মানবাধিকার কর্মী