Media trial and laws relating to character assassination
ঢাকার একটি ক্লাবে মধ্যরাতে যৌন হামলা ও হত্যা চেষ্টার শিকার হয়ে মামলার আগে পুরো ঘটনাটি ফেসবুকে প্রকাশ করে সবার সহযোগিতা চেয়েছিলেন অভিনেত্রী পরীমনি। এরপরই পুলিশ মামলা নিয়ে আসামীদের আটক করে আদালতে উপস্থাপন করে। আদালত তাদের রিমান্ডের আবেদনও মঞ্জুর করে।
কিন্তু ফেসবুকে গত বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরীমনির পোস্টে নানা ধরণের ইমোজি ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ৩ লাখ ৩৩ হাজার ব্যক্তির। এর মধ্যে হা হা রিয়েকশন দিয়েছেন ৭১ হাজার মানুষ। অর্থাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের এক পঞ্চমাংশই পরীমনির অভিযোগ নিয়ে হাসিতামাশা করেছেন।
পরীমনি তার ওপর যৌন হামলা ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগ জানানোর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই উল্টো তাকেই দোষারোপ করে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন নারী কোন ঘটনায় জড়িত হলে তাকে কেন্দ্র করে এ ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় মূলত আইনি কাঠামোর দুর্বলতা, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী আর পারপারিক শিক্ষার অভাবের কারণে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সক্রিয় একজন ব্যবহারকারী আহমদ মম বলছেন, এ ধরণের ঘটনায় শুধু লাইক দিয়ে বা হাহা রিয়েক্ট দিয়েও অনেকে ক্ষান্ত হন না বরং নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেন ভিকটিম নারীকেই।
তিনি বলেন, “শুধু ধর্ষণের ঘটনা দিয়েই উদাহরণ দেয়া যায়। একটা মেয়েকে ধর্ষণের শিকার হলে তাকে বরং দোষ দেয়া হয় যে ও কেন সেখানে গেলো। মেয়েটা কেন ছোট পোশাক পড়লো। এভাবে নারীকে দোষারোপ করতে গিয়ে তারা মূলত অপরাধটাকেই সমর্থন করে বসেন”।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের মনোভাব প্রকাশকারীর সংখ্যা যেমন অনেক বেশি চোখে পড়ছে যারা কোনো রাখঢাক না করেই কোন ঘটনায় আক্রান্ত নারীকেই পাল্টা দোষারোপ করছেন যাকে ভিকটিম ব্লেমিং বলা হয়। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যত বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে তত বেশিই এ ধরণের প্রবণতা বাড়ছে।
তবে আইনজীবী মিতি সানজানা বলছেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি আগেও ছিলো তবে এখন আরও বাড়ছে আর এ বড় কারণই হলো পারিবারিক শিক্ষার অভাব।
তিনি বলেন, “পুরুষতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে সব প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় আইন, সমাজ ও পরিবারকে ব্যবহার করা হয়। অবশ্যই এটি পারিবারিক শিক্ষার ব্যাপার। যত আইন থাকুক না কেন, আপনি একজন নারীর সাথে কি ধরণের আচরণ করবেন তা আইন দিয়ে শেখানো যায় না। পারিবারিক মূল্যবোধ ও শিক্ষার ব্যাপারটি এখানে জরুরি। সন্তানকে জেন্ডার সংবেদনশীল হিসেবে গড়ে তোলা শুরু হয় পরিবার থেকে। তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র। কিন্তু প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকে শুরু হয়। সে জায়গাতেই অনেক গ্যাপ রয়ে গেছে”।
অর্থাৎ আগেও অনেকে এ ধরণের মনোভাবই পোষণ করতেন নারীদের নিয়ে কিন্তু সেটি প্রকাশ করার সুযোগ পেতেন না। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হওয়াতেই বিশেষ করে ফেসবুকের কারণে সহজেই কারও মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে অন্যরা জানতে পারছে। আর তাতে এটি পরিষ্কার যে নারীর প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউই রেহাই পাচ্ছে না তা তিনি সেলেব্রিটি হোন বা সাধারণ কোন নারীই হোন।
অনেক সময় ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনমতকে বিবেচনায় নিতে দেখা যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। ফলে প্রশ্ন উঠছে যে তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়াতেও এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাব ফেলতে পারে কি না। এর সাথে একমত আইনজীবী মিতি সানজানাও।
“বিচারকার্যের সাথে যারা জড়িত তারা কিন্তু মানুষ। যখন মিডিয়াতেই কে দোষী বা নির্দোষী তা বলে দেয়া হচ্ছে মিডিয়া ট্রায়াল করে সেটি তো বিচারের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। একটা পক্ষপাত কাজ করতে পারে। কেউ কেউ সেভাবে গ্রেফতার হচ্ছেন। কিন্তু সেটি হওয়া উচিৎ নয়। আইন নিজের গতিতেই চলা উচিত। কোন মিডিয়া ট্রায়াল বা প্রেশারে প্রভাবিত হয়ে নয়”।
তবে এটি যে কেউ ঘটনার শিকার হলেই তাও আবার নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কোন নারীকে পুলিশ আটক করলেও দেখা যাচ্ছে যে অভিযোগের চেয়ে নারীকে নিয়েই বেশী আলোচনা হচ্ছে। করোনা বিষয়ক দুর্নীতির অভিযোগে আটক হওয়া ডঃ সাবরিনা চৌধুরীর ক্ষেত্রে এটিই দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আবার একজন নারী সাংবাদিককে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক একজন উপদেষ্টার আপত্তিকর বক্তব্য নিয়ে শোরগোলের সময়েও অনেকে ওই নারীকেই আক্রমণ করে মন্তব্য করেছিলেন অনেকে। একই ভাবে সাবেক সেনা কর্মকর্তা স্বামীর কারণে আলোচনায় এসে বাজে আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন টিভি উপস্থাপক ফারজানা ব্রাউনিয়াও।
কিন্তু কেন সবসময় নারীরা এভাবে আক্রমণের শিকার হন। জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক ফারজানা খন্দকার বলছেন, ভিকটিম ব্লেমিং অনেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এটিকে উৎসাহিত করছে।
“ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমেও কিন্তু ভিকটিম ব্লেমিংয়ের সুযোগ থেকে যায়। বাংলাদেশে এগুলো পলিটিক্যালি মোটিভেটেড হয়ে যায়। একটা নির্দিষ্ট শ্রেণী থাকবে যে তাদের দিয়ে একটা ভাইব তৈরি করা হবে। একটা মানুষের সাথে কি অপরাধ হয়েছে বা একটা মানুষ কি অপরাধ করেছে সেটা চিন্তা না করে অতীতের ওপর ভিত্তি করে তার বিরুদ্ধে বা পক্ষে জনসম্মতি বা জনরোষ তৈরি করতে চাই। এটা বাংলাদেশের মিডিয়া কালচার হয়ে গেছে আর সাধারণ মানুষ এটা আগে থেকেই চর্চা করে”।
তবে শুধু সেলেব্রিটিরাই নন, অনেক সময় এমনকি ই-কমার্সে জড়িত থাকা নারীরা তাদের নানা পণ্য নিয়ে ফেসবুক লাইভ করেন কিংবা অনেক গণমাধ্যমেও নিয়মিত ফেসবুক লাইভ করে সংবাদ বিশ্লেষণের মতো নানা আয়োজন হয়ে থাকে।
লাইভ এসব অনুষ্ঠানের কমেন্ট সেকশনেও অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে অনেকে আগ্রহী হয়ে উঠেন উপস্থাপক নারী ও তার পোশাক নিয়ে। ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টার থেকে এমন একটি অনুষ্ঠান ফেসবুকে লাইভ করা হয় যার উপস্থাপনা করেন পত্রিকাটির নারী সাংবাদিকরাই। এর একজন উপস্থাপক নাজিবা বাশার বলছিলেন যে তিনি নিজেই প্রতিটি পর্বেই কি ধরণের পরিস্থিতির শিকার হন।
“আমাদের ভিডিওগুলো ফেসবুকে আপলোড হওয়ার সাথে সাথে অনেকে দেখেন। কিন্তু যারা দেখেন তাদের বেশিরভাগই কমেন্ট করেন তারা নিউজটা দেখছে না। তাদের মাথাব্যথা হলো আমার পোশাক। আমি ওড়না পড়িনি কেন। এসব নিয়েই বেশি কমেন্ট হয়। যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি সেটা নিয়ে কমেন্ট সেকশনে আলোচনা কম হয়। যারা কমেন্ট করেন তাদের বেশিরভাগই দৃষ্টিভঙ্গি একই। তারা উদ্বিগ্ন যে মেয়েটা কি করছে বা মেয়েটা কেন শো করছে”।
তবে এটি শুধু বিশেষ কোন ঘটনা বা ইস্যুতে এখন আর সীমাবদ্ধ থাকছে না। নারী এমনকি মেয়ে শিশুদেরও নানা ধরণের কটুক্তির শিকার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এমনকি অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর শোক জানিয়ে পোস্ট দিয়ে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ঢাকার একজন সুপরিচিত অভিনেত্রী জয়া আহসান।
আবার চলতি বছরের জানুয়ারিতেই রাজধানীর কলাবাগানে ধর্ষণের শিকার হন ও-লেভেল পড়ুয়া এক স্কুল শিক্ষার্থী। অতিরিক্ত রক্তপাত শুরু হলে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন মেয়েটিকে।
ঘটনাটি প্রকাশের পর ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি অপরাধী কি না সেটি আদালতে নির্ধারণের আগেই সামাজিক মাধ্যমে এক দল ব্যক্তি দোষারোপ করতে শুরু করেন ভুক্তভোগী মেয়ে ও তার পরিবারকেই। অনেকেই লিখেছেন খালি বাসায় মেয়েটি কেন গেলে বা ছেলেদের সাথে মেয়েদের বন্ধুত্বের দরকার কি কিংবা মেয়ের মা তাকে কোন শিক্ষা দেয়নি অথবা তার জামাকাপড় ঠিক ছিলো না- এমন সব মন্তব্যে সয়লাব হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি এতোটা বেড়ে গেলো গেল কেন এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলছেন এখন যা হচ্ছে তা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন আর সাথে আছে দুর্বল আইনি কাঠামো- দুটি মিলেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
“যারা অনলাইন বা অফলাইন ব্যবহার করছেন তাদেরকে এটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে এ বিষয়গুলো অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছি এবং যারা এগুলো করছেন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র শক্ত পদক্ষেপ নেবে-এই বার্তা যতদিন জনগণের কাছে না যাবে ততদিন নারীদের সুরক্ষা দেয়ার প্রশ্ন শক্তভাবে দেখা সম্ভব হবে না”।
তিনি বলেন নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার গাইডলাইন থাকা উচিত প্রতিটি স্তরে এবং একই সাথে দরকার শক্ত আইনি কাঠামো যাতে যৌন হয়রানিকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার।
“আমাদের পর্নগ্রাফিক কন্ট্রোল আইন আছে বা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট আছে। কিন্তু নারীরা নিরাপদে কিভাবে ডিজিটাল জগতে থাকবেন সেদিকে মোটেও নজর দেয়া হয়নি। আইন কাঠামোতে আসলে চিহ্নিত করা দরকার যে এগুলো যৌন হয়রানি এবং এগুলো করলে তা হবে অপরাধ। আর সে অপরাধের জন্য শাস্তিও থাকতে হবে”।
বাস্তবতা হলো নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে প্রতিনিয়ত যেসব মন্তব্য বা আচরণ দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেগুলোর যেমন কোন প্রতিকার দেখা যায় না তেমনি নানা ধরণের ধর্মীয় সভা সমাবেশে নারী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য নিয়েও কাউকে সরব হতে দেখা যায় না। বরং এগুলো অনলাইনে ব্যাপক ভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের নীনা গোস্বামী বলছেন পুরো বিষয়টির সাথেই জড়িয়ে আছে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবর্তন আনতে হবে সেখানেই।
তিনি বলেন, “সমাজ যে মানসিকতা পোষণ করে তারই একটা বহিঃপ্রকাশ। নারীকে কোন দৃষ্টিতে দেখছে এবং কোন কিছু হলে যেন সব দোষই নারীর। ভিকটিম হলেও আবার অভিযুক্ত হলেও। সেটা নিয়েই বেশি আলোচনা হতে দেখা যায় বা মিডিয়ায়ও তা হাইলাইট হয়। সামাজিক মাধ্যমে সেটা নিয়েই বেশি আলোচনা হয়”।
অর্থাৎ নারীর প্রতি এমন দৃষ্টি বাংলাদেশের সমাজের গভীর থেকেই আসা। যা থেকে বের হতে একদিকে যেমন যথাযথ শিক্ষার দরকার তেমনি দরকার শক্ত আইনি কাঠামোর যাতে নারীকে নারী হবার কারণে হেয় প্রতিপন্ন করে কেউ যেন সহজে পার না পেতে পারে।