সম্প্রতি উচ্চ আদালতে রায় হয়েছে, মায়েরা সন্তানের অভিভাবক হিসেবে থাকতে পারবেন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাবাই অভিভাবক হিসেবে থাকতেন, এই রায়ের ফলে সমাজে এর প্রভাব, জাপানি দুই শিশুর ব্যাপারে সম্প্রতি হাইকোর্টের রায়, নারীর ক্ষমতায়নে দেশের আইন বিভাগ এবং সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ- এসব নিয়েই বাংলা ইনসাইডারের সাথে কথা হয়েছে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মিতি সানজানা- এর সঙ্গে। তিনি বাংলা ইনসাইডারের সাথে একান্ত আলাপকালে জানিয়েছেন নারীর ক্ষমতায়ন, সম্প্রতি হাইকোর্টের রায় এবং সমাজে এর প্রভাবের কথা। পাঠকদের জন্য আইনজীবী মিতি সানজানার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা ইনসাইডার-এর নিজস্ব প্রতিবেদক আল মাসুদ নয়ন।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, এখানে যে বিষয়টি সেটি আসলে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। এখানে শুধুমাত্র আগে যেখানে ফরম পূরণ করার ক্ষেত্রে বাবার নামটা বাধ্যতামূলক ছিল, এখন বাবার নামটা বাধ্যতামূলক না। যদি কেউ পিতৃ পরিচয়হীন থাকেন বা পিতা না থাকেন কিংবা বাবার নাম তারা উল্লেখ করতে না চান, সেক্ষেত্রে মায়ের নাম ব্যবহার করা যাবে বা অন্যান্য যদি অভিভাবক থাকে, যারা ছিন্নমূল শিশু আছে রাস্তায় পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো অন্য যারা অভিভাবক আছেন, আইনগত অভিভাবক আছেন, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো এটি প্রয়োজ্য হবে। কাজেই বাবার নাম বাধ্যতামূলক নয়। এর মাধ্যমে মা যে অভিভাবক হয়ে যাচ্ছে আসলে ব্যাপারটা তা না।
তিনি বলেন, ‘মা কখনোই সন্তানের অভিভাবক না, পিতা হচ্ছে সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক।’
সম্প্রতি জাপানি দুই শিশুকে মায়ের তত্ত্বাবধানে দেয়া হলো, সেক্ষেত্রে কি আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি না? -এমন প্রশ্নের উত্তরে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে জিম্মাদার হিসেবে আইনে যা ছিল, পারিবারিক আইনে যা ছিল সেটাই। স্পষ্ট করে বলতে চাচ্ছি যে, শুধুমাত্র বাধ্যতামূলকভাবে পিতার নাম ব্যবহার করা না এবং এখানে বলা আছে যে, পিতৃ পরিচয়হীন শিশু। কাজেই সেই পিতৃ পরিচয়হীন শিশুর যে স্টিগমা (কলঙ্ক), কেউ যদি নাম উল্লেখ করতে না চান, তাদেরকে ধরে নিতে হবে, তাদের পিতৃ পরিচয় নেই বা তাদের আসলে সেই স্টিগমা-টা (কলঙ্ক) নিয়েই এই ধরনের ফরমগুলো পূরণ করতে হবে। এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রায় আমরা দেখি নাই। এখন পর্যন্ত আমরা জানি যে, শুধুমাত্র শিক্ষাক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য।
তিনি বলেন, সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবক পিতা, মাতা কখনও সেই অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারেন না। যদি না আদালত তাকে মনোনীত করে। সেটি পিতার অধিকার। সন্তানের শরীর এবং সম্পত্তির সম্পূর্ণ অভিভাবক হচ্ছেন বাবা। অভিভাবক হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি সন্তানের শরীর এবং সম্পত্তির দায়-দায়িত্বে থাকেন এবং সমস্ত ভরণ-পোষণের তত্ত্বাবধানেও থাকেন। মা শুধুমাত্রই জিম্মাদার, তা-ও একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। তারপরের থেকে সে আসলে বাবার জিম্মাদারিত্বে চলে যায়। তবে যদি কোর্ট মনে করে যে, সন্তানের সর্বোত্তম কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য মা’র কাছেই থাকবে তখন শুধুমাত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা শুধুমাত্র কাস্টডি (হেফাজত) পান, তবে সবক্ষেত্রে এটা না।
সমসাময়িক সময়ে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সরকার কি ধরনের পদক্ষেপগুলো নিয়েছে এবং কি ধরনের পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, উনারা শীর্ষ পর্যায়ে আছেন। শীর্ষ পর্যায়ে যারা আছেন, তাদের দিয়েই যদি আমরা বাংলাদেশের বড় দৃশ্যপটটি দেখি, সেটিই তো আসলে সব নয়। বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে অর্ধেকের বেশি হচ্ছে নারী। এখানে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার- উনাদের উদাহরণ দিয়ে বিচার করা যায় না। উচ্চপদস্থ কয়জন সিইও আছে, সেটা দিয়েও বিচার করা যায় না। তৃণমূল থেকে সর্বস্তরে কয়জন নারীর ক্ষমতায়ন হলো, সেটি দেখার বিষয়। সমাজে নারীর প্রতি যে সম্মান এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো কি না, তা দিয়েই নারীর উন্নয়ন বিচার করা উচিত।
ব্যারিস্টার মিতি সানজানা বলেন, সারাদেশের যে চিত্রটি আমরা দেখি, বাংলাদেশের নারীরা এখন পর্যন্ত সম্মানের জায়গা থেকে যদি দেখি, সে জায়গাটি এখন পর্যন্ত আমি মনে করি তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। অনেক নারীবান্ধব আইন হয়েছে, অনেক কিছু ফ্যাসিলিটেড (সুবিধাজনক) করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সরকার ভালো ভালো পদক্ষেপ নিচ্ছেন নারীবান্ধব। কিন্তু সেটি আসলে পারিবারিক শিক্ষা থেকে শুরু করে আইনের যে প্রয়োগ, আইনের প্রয়োগের জায়গাটিতে অনেক অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এখনও আমরা দেখি সর্বোচ্চ আদালত থেকে বলা হয় যে, মহিলা কাজী (বিয়ের কাজী) নিয়োগের ক্ষেত্রে যে রায় আমরা দেখতে পেয়েছি, মহিলা কাজী দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ ধরনের বিষয়গুলো আসলে খুবই দুঃখজনক। অনেক কিছুই এখনও আমরা দেখতে পাই, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, অনেক বহুদূর যাওয়ার রয়েছে আমাদের।